দখিনের খবর ডেস্ক ॥ দেশের প্রান্তিক কৃষকরা ধানের বাম্পার ফলন ফলিয়েও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ধান আর চালের সঙ্গে কৃষক, চাতাল মালিক অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু দিনে দিনে কৃষকরা গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে। আর মধ্যস্বত্বভোগী চাতাল মালিকরা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফায় ফুলেফেঁপে উঠছে। তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি বিএআরসি এবং ব্রি’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৩ বছরে (২০১৭ থেকে ২০১৯) আমন মৌসুমে প্রতি কেজি চালে চাতাল মালিকরা ৪ টাকা ৬০ পয়সা থেকে সাড়ে ৯ টাকা পর্যন্ত লাভ করেছে। আর বিগত ২০২০ সালের প্রতি কেজি চালে লাভ করেছেন ৪ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৮ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত। আর বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মৌসুমের শুরুতেই এক মাসের মধ্যেই কৃষক উদ্বৃত্ত ধানের ৫২ শতাংশ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে ২৫ শতাংশ; দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ১৮ শতাংশ এবং চার মাস বা তার বেশি সময়ের মধ্যে বিক্রি করা হচ্ছে ৫ শতাংশ ধান। ধার দেনা-মহাজনের কাছে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করায় কৃষকদের ধান কেটেই বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে ২০১৯ সালে এক মাসের মধ্যে বিক্রি হয়েছিল ৬৫ শতাংশ ধান, যেখানে এক থেকে দুই মাসের মধ্যে ছিল ২০ শতাংশ, দুই-তিন মাসের মধ্যে ১৩ এবং চার মাস বা ততোধিক ছিল ২ শতাংশ। মূলত গত বোরো মৌসুমে ধানের ভালো দাম পাওয়ার কারণে প্রথম মাসে বিক্রির প্রবণতা কিছুটা কম ছিল। সূত্র জানায়, ফসল তোলার প্রথম মাসের মধ্যে যে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে, তা কৃষকের জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ধানের মজুদাগার ও আর্থিকভাবে কৃষকদের সক্ষম করে তুলতে পারলে কৃষকের ধানের মাধ্যমে আরো বেশি লাভবান করা সম্ভব। গত কয়েক বছরে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়লেও শস্যটির প্রকৃত দাম কমে গেছে। কোনো কোনো বছর বোরো ধানে কৃষক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। যেখানে দেশের আবাদি জমির সিংহভাগেই বোরো ধান চাষ হয়। বোরো আবাদে কৃষকের হেক্টরপ্রতি লোকসান এখন প্রায় ৬ হাজার টাকা। ওই লোকসানের অন্যতম কারণ শ্রমিক ব্যয়। পারিবারিক ও ভাড়া শ্রমিকের পেছনে ব্যয় হচ্ছে মোট উপকরণ খরচের প্রায় ৪৬ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষিপণ্যের আধুনিক বাজার ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিকীকরণ দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সূত্র আরো জানায়, গত বছর দেশে ৩ কোটি ৮৭ লাখ ২২ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে ধান উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৪ শতাংশের থেকেও বেশি। ফলে প্রতি বছর ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। তারপরও মজুদ প্রবণতাই এ বছর চালের অস্বভাবিক দামের প্রধান কারণ। করোনায় খাদ্য ঘাটতির শঙ্কায় ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা প্রচুর চাল মজুদ করে রাখে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত সরকারের নানামুখি দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল মজুদ করে। আর সরকার চাল সংগ্রহ ও যথাসময়ে চাল আমদানি করতে পারেনি। পাশাপাশি যথাযথ হস্তক্ষেপ করতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এসবের সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। চালে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে মিলার, আড়তদার এবং পাইকাররা অতি মুনাফা করে। তাছাড়াও মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং অসম প্রতিযোগিতা, আমনের উৎপাদন ঘাটতি, চাল আমদানি বন্ধ, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারণে চালের বেশি পরিমাণে দাম বেড়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, জমির পরিমাণ বা আকারের হিসাবে দেশের প্রায় ৮৩ শতাংশ কৃষকই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র। শূন্য দশমিক ৫ একরের নিচে এমন আকারের জমি আবাদ করে থাকে ৩৬ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক। আর শূন্য দশমিক ৫ থেকে দেড় একরের কম জমি আবাদ করে ৪৭ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক। ফলে দেশের সিংহভাগ কৃষকই ক্ষদ্র ও ছোট জমিতে আবাদ করে। ওসব জমিতে আবাদের মাধ্যমে কৃষক নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য আর্থিক এবং সামাজিক চাহিদা পূরণ করে। তাতে চাহিদা মেটানোর জন্য কাটার শুরুতেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষক। আর এই সুযোগ নিচ্ছে মিলার ও ফড়িয়ারা। তাছাড়া চালের উপজাতসমূহ (বাই প্রডাক্ট) থেকেও মিল মালিকদের প্রচুর আয় হচ্ছে। কিন্তু তারা কোনও হিসাবে তা বিবেচনায় আনছে না। ফলে প্রতি বছরই ধানের প্রকৃত মূল্য কমছে। ফলে সার্বিকভাবে কৃষকদেরই লোকসান হচ্ছে। ১৯৭২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ধানের বাজার মূল্য ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে বাড়লেও এর প্রকৃত মূল্য প্রতি বছর ৩ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। বিগত ২০০৯ থেকে ২০২০ সময়কালে কেজি প্রতি ধান চাষের ব্যয় ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে। কিন্তু সব মিলে কৃষকের নিট মুনাফা ৮ শতাংশ হারে কমেছে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম জানান, কৃষক ভালো নেই। প্রধানত দুটো কারণে মৌসুমের শুরুতেই কৃষক ধান বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রথমত, কৃষক ধারদেনা করে ধান উৎপাদন করে বিধায় দ্রুত অর্থ পরিশোধের তাড়া থাকে। অন্যদিকে কৃষকের ঘরে এখন আর বাড়তি জায়গা নেই। ফলে আর্থিক সক্ষমহীনতা ও মজুদাগারের অভাবে বাধ্য হয়েই ধান বিক্রি করে দিচ্ছে কৃষক। এ কারণে ধানের বাজারের নিয়ন্ত্রণ মিলার ও ট্রেডার্সদের হাতে চলে গেছে। অন্যদিকে ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, একদিকে ক্ষুদ্র কৃষক অন্যদিকে আর্থিক সক্ষমতাহীনতা। এ দুটোর প্রভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেশ ঝুঁকিতে থাতে কৃষক। মিলারদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো কৃষকের ওই আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাজার থেকে সবচেয়ে কম দামে ধান কিনতে পারা। তাই কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা বাড়াতে হবে। সংগ্রহ পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে হবে। ধান আবাদে কৃষককে লাভবান করতে না পারলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
Leave a Reply